কৃষি-জিডিপির উন্নতি হলেই কি বাংলাদেশের দারিদ্রতা কমবে?
কৃষি-জিডিপির উন্নতি হলেই কি
বাংলাদেশের দারিদ্রতা কমবে?
বৎসরান্তে কোনো দেশের বিক্রীত পণ্য বা পরিষেবার মোট মূল্যকে জিডিপি বলে,
যাকে পুরোপুরিভাবে বলা হয় গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট বা দেশজ পণ্যের মূল্য।
একটি দেশ কত উন্নত,
তা জিডিপি দিয়ে বোঝা যায়। অর্থাৎ,
যে দেশের জিডিপি যত বেশি,
সে দেশের আয় তত বেশি। আরো সোজা সাপ্টা করে বললে,
যে দেশের জিডিপি যত বেশি,
সেই দেশ তত ধনী।
তবে জিডিপি বেশি হলেই যে সাধারণ মানুষের জীবন মান উন্নত হবে,
এ নিয়ে বিস্তর বিতর্ক রয়েছে।
কৃষি উপখাত সমূহের মধ্যে কোনটির জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বেশি ছিল?
এর আগের প্রবন্ধে আমি আপনাদেরকে বাংলাদেশের জিডিপি সম্মন্ধে একটু ধারণা দিয়েছিলাম। ওই প্রবন্ধে আমরা জেনেছিলাম বাংলাদেশের মোট জিডিপির পরিমান কত, জিডিপির প্রধান খাতগুলো কি কি, প্রতিটি প্রধান খাতের আওতায় কি কি উপখাত রয়েছে এবং কোন কোন উপখাতগুলো বাংলাদেশের অর্থ সামাজিক উন্নয়নে প্রধান ভূমিকা রাখছে।
তবে আজকেপ্রবন্ধে বিষয়টি যাতে আমাদের সহজে বোধগম্য হয়, সে জন্য আসুন আগের প্রবন্ধে হতে কিছু কিছু অংশ আমরা একটু উল্লেখ করি।
বাংলাদেশের বার্ষিক জিডিপি কত?
বাংলাদেশের বার্ষিক জিডিপি ২০২২-২০২৩ আর্থিক বছরে ছিল ৪৪ লক্ষ্য হাজার টাকার উপরে,
৪৪ লক্ষ্য ৩৯ হাজার ২৭৩ দশমিক ৩ কোটি টাকা
(4,43,92,733 মিলিয়ন টাকা হয়)।
বাংলাদেশের জিডিপির প্রধান প্রধান খাতগুলো কি?
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রধান ভূমিকা রাখে, এরকম প্রধান খাত-উপখাতগুলো কি কি?
বাংলাদেশে তিন লক্ষ্য হাজার কোটি টাকার উপরে যে যে খাত-উপখাত হতে জিডিপি আসে সেগুলো নিন্মরূপ:
সর্বোচ্চ জিডিপি আসে শিল্পখাতের উৎপাদন উপখাত হতে,
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উপখাত হলো দোকান ব্যবসা, তৃতীয় সর্বোচ্চ খাত হলো কৃষি, চতুর্থ উপখাত হলো নির্মাণ,পঞ্চম উপখাত হলো রিয়েল স্টেট এবং ষষ্ঠ উপখাত হলো পরিবহন ও গুদামজাতকরুন ব্যাবসা। এই খাত উপখাতগুলোর প্রতিটি হতে জিডিপি আসে তিন লক্ষ্য হাজার কোটির উপরে প্রায় দশ লক্ষ্য হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ।
এই তিনটি সেক্টরের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির চিত্রটি কেমন?
এই তিনটি খাতের মধ্যে কেবলমাত্র শিল্প খাতের প্রবিদ্ধি পসিটিভ রয়েছে। বাকি দুটি খাত অর্থাৎ সেবা ও কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে।
সব চাইতে বেশি কমেছে কৃষি খাতে। একত্রিশ ভাগের মত । যেটা কৃষি প্রধান একটি দেশের কাম্য
নয়। তবে হ্যা, শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি অবশ্যই আমাদের সন্তুষ্ট করে। উর্ধমুখী শিল্প খাতের
একটি কৃষি প্রধান দেশের রাষ্ট্রীয় পলিসি হওয়া
উচিত শিল্প ও কৃষিকে পরস্পরের সম্পূরক খাত হিসেবে রূপান্তর করা। এই বিষয়টি আমরা পরের
আর একটি ভিডিওতে আলোচনা করবো।
কৃষি খাতের জিডিপির প্রবৃদ্ধি কমে গেলেও মোট কৃষি জিডিপি কি কমেছে?
না কমেনি,
বরং বেড়েছে।
বাংলাদেশের কৃষি জিডিপির উপখাতগুলো কি কি এবং সেগুলো হতে কেমন জিডিপি আসে?
আজকের এই প্রবন্ধে যা যা থাকবে: মোট জিডিপিতে অন্য সেক্টরের চাইতে কৃষি সেক্টরের অবদান কম থাকলেও কেন বাংলাদেশের সামগ্রিক-অর্থনীতিতে কৃষির অবদান সবচাইতে বেশি হওয়া উচিত
আর এই কেনো উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদেরকে আরো কিছু
প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে;
·
১
বর্তমানে কৃষি জিডিপি অন্য খাত হতে কম রয়েছে। এই অবস্থাকি স্বাধীনতার আগেও ছিল ?
·
২
স্বাধীনতার পর হতে বাংলাদেশের জিডিপির বৃদ্ধির সাথে সাথে কৃষির জিডিপি বাড়েনি কেন?
·
৩
অন্যান্য উন্নয়নশীল মধ্যম আয়ের দেশের
কৃষি জিডিপি কেমন?
·
৪
বিভিন্ন উচ্চ আয়ের ধনী দেশের কৃষি জিডিপি
কেমন?
·
৫
অন্য দুটি খাতের তুলনায় বাংলাদেশের কৃষি জিডিপি কি আসলে কম?
আর
সব শেষে আমরা বিশেষ করে দেখবো,
· ৬ কম জিডিপির কৃষির গুরুত্ব বাংলাদেশের অর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে কতটুকু?
পরের
আর একটি প্রবন্ধে আমরা জানবো যে কি কি পদক্ষেপ নিলে বাংলাদেশের কৃষির জিডিপি বাড়ানো
যাবে।
প্রিয় পাঠক,
কিছুক্ষন আগে আমরা দেখেছিলাম যে
বাংলাদেশে জিডিপির প্রধান তিনটি খাত রয়েছে। কৃষি,
শিল্প ও সেবা।
এই খাতগুলোর প্রত্যেকটির আওতায় কয়েকটি করে উপখাত রয়েছে। কোনোটি বড় আবার কোনটি ছোট।
জিডিপির বড় বড় কোন কোন খাত-উপখাত হতে বাংলাদেশে বেশি বেশি জিডিপি আসে
এই ব্যাপারটিও আমরা কিছুক্ষন আগে জেনেছি। এই ব্যাপারগুলো আগের ভিডিওতে বিস্তারিত আলোচনা
করেছি। আপনি যদি ওই ভিডিওটি না দেখে থাকেন, তাহলে দেখে নিতে পারেন। আগের ভিডিওটিই ছিল
এই চ্যানেলের প্রথম ভিডিও যেটির লিংক এই ভিডিওর ডেসক্রিপশন বক্সে দেয়া থাকবে।
তবে আগের ভিডিওতে আমরা দেখেছি যে বাংলাদেশের সবচাইতে বড় যে খাতটি, তা হলো সেবা খাত যেখান থাকে জিডিপি আসে ৫১ ভাগ। তার পরের বড় খাত হলো শিল্প খাত। এই শিল্প খাত হতে জিডিপি আসে ৩৪ ভাগ। আর সেবা খাত হলো তৃতীয় খাত যেটি হতে বর্তমানে জিডিপি আসে ১১ দশমিক ২২ ভাগ। অর্থাৎ, কৃষি হলো বাংলাদেশের সবচাইতে ছোট খাত যেখান হতে মোট জিডিপির মাত্র ১১ ভাগের মতো জিডিপি আসে।
উপরের চিত্রটি হতে আমরা জানলাম, কৃষি খাতটি সেবা ও শিল্প খাতের দুটি উপখাতের চাইতেও কম জিডিপি বহন করে। আমরা বলি বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। এ দেশের অর্থনীতি কৃষির উপর নির্ভরশীল। কৃষি হতে যদি মাত্র ১১ ভাগ জিডিপি আসে, তাহলে বাংলাদেশ কেমন করে কৃষি প্রধান হয় ?
তবে আমরা যদি জানতে চাই যে
বাংলাদেশের মোট জিডিপিতে কৃষি ও অন্য খাতের কোন উপখাতগুলোর ভূমিকা বেশি ? নিচের সারণিতি লক্ষ্য করুন;
কৃষি খাত সেবা ও শিল্প উপখাত উৎপাদন ও দোকান ব্যাবসার চাইতেও কম জিডিপি আনে। শিল্প খাতের উৎপাদন খাত হতে বাংলাদেশের জিডিপি হলো নয় লক্ষ্য তিরাশি হাজার কোটি টাকার উপরে। সেবা খাতের দোকান ব্যবসা হতে আসে ছয় লক্ষ্য চল্লিশ হাজার কোটি টাকার উপরে। আর কৃষি হতে আসে চার লক্ষ্য ছিয়াশি হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি।
এবারে আজকের প্রবন্ধের প্রথম প্রশ্নে
আসুন,
প্রশ্ন-১ বর্তমানে কৃষি জিডিপি অন্য খাত হতে কম রয়েছে। এই অবস্থাকি
স্বাধীনতার আগেও ছিল ?
প্রথমে আসুন স্বাধীনতার আগের বিষয়টি।
জ্যাস্টর .org এর একটি ওয়েবসাইটের তথ্য মতে বাংলাদেশ তথা পাকিস্তান আমলের পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৪৯ হতে ১৯৬০ এর তথ্য মতে জানা যায় যে প্রাক স্বাধীনতা যুগে জিডিপিতে কৃষির অবদান অন্য সব খাত হতে বেশি ছিল। সে সময়ে ১৯৪৯/৫০ সালে বাংলাদেশের মোট জিডিপি ছিল পৌনে তেরোশো রুপি যার মধ্যে ৬৫% ভাগই আসতো কৃষি খাত হতে। বাকি ৩৫% আসতো শিল্প ও সেবা খাত হতে। দশ বছর পর অর্থাৎ ১৯৫৯/৬০ সালে জিডিপিতে কৃষির অবদান ছিল ১৪ শ বাষট্টি কোটি রুপি যার মধ্যে ৬০ শতাংশ ছিল কৃষি খাত হতে। বাকি চল্লিশ শতাংশ আসতো শিল্প ও সেবা খাত হতে। তাহলে আমরা দেখলাম যে প্রাক স্বাধীনতা যুগে জিডিপিতে কৃষির অবদানই ছিল অনেক বড়।
তাহলে আমরা কি দেখলাম? পঞ্চাশের দশকে বাংলাদেশের জিডিপি কৃষি
নির্ভর ছিল।
আমরা এর আগের ছবিগুলোতে দেখলাম,,
১৯৬০ সাল হতে বাংলাদেশের তথা পূর্ব পাকিস্তানের কৃষি জিডিপি কেমন ছিল ? স্বাধীনতার
পর তা কেমন হয়েছে ? ২০০৮ সালে কৃষি জিডিপি
৭৭৩ হাজার কোটি টাকা (a) হতে ৩১% (b) বেড়ে
হয়েছে ১০১২ হাজার কোটি টাকা (c)।
দেখুন পরের গ্রাফে, কৃষি
জিডিপির অবদানের প্রবাহ ধারাটি কমতির দিকে।
অর্থাৎ পাকিস্তান আমল শেষ হওয়ার পরও বাংলাদেশের কৃষি জিডিপির অবদানের প্রবাহ ধারা কমতির
মধ্যেই ছিল।
তবে এর মানে এই নয় যে কৃষি
খাত হতে আমাদের জিডিপি কমে গেছে যেটি আমরা আগের গ্রাফগুলো হতে প্রত্যক্ষ করেছি। এ সময়কালে
কৃষি জিডিপির অবদানের প্রবাহ ধারাটি কমে গেছে; কারণ, দেশের মোট জিডিপিতে অন্নান্ন খাতের অবদান বেড়ে যাওয়াতে
কৃষির অবদান কমেছে। মানে জিডিপির অবদানে কৃষির
বাইরের অন্নান্ন খাতের অবদান যোগ হয়েছে। আমরা এর আগের গ্রাফটিতে দেখেছি, ২০০৮ সালে
বাংলাদেশের কৃষির জিডিপি ছিল ৭৭৩ কোটি টাকা, দশ বছর পরে ২০১৮ সালে তা দাঁড়িয়েছে এক
হাজার বারো কোটি টাকার মতো। মানে এই দশ বছরে বাংলাদেশের জিডিপি ৩১ ভাগ বেড়েছে। অথচ এই বছরগুলোতে কৃষির জিডিপির অবদানের প্রবাহ
ধারা কমে গেছে। ব্যাপারটি স্পষ্ট হবে। পরের চিত্রটি দেখুন,
Worldbank.org মতে স্বাধীনতার পর হতে বাংলাদেশের মোট জিডিপিতে কৃষির
শেয়ার কমে গেছে।
কিছুক্ষন আগের একটি চিত্রে
আমরা দেখলাম ২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশের কৃষি জিডিপি স্থিরভাবে বেড়েছে। অথচ মোট জিডিপিতে
কৃষির অবদান কমে গেছে। এ সময়কালে বাংলাদেশের কৃষি জিডিপি বাড়লেও মোট জিডিপিতে অন্নান্ন
খাত যেমন সেবা ও শিল্প খাতের জিডিপির অবদান ১০০% এর সাথে যোগ হওয়াতে কৃষির অবদান কমে
গেছে (উপরের চিত্র)।
তাহলে যে প্রশ্নটি ছিল যে স্বাধীনতার
আগে কৃষি জিডিপির অবস্থা কেমন ছিল এবং স্বাধীনতার পরে কেমন হয়েছে এর উত্তর হলো স্বাধীনতার
পরে কৃষি জিডিপির প্রবাহ ধারা কমতির পর্যায়ে থাকলেও ২০০৮ এর পর দশ বছরের ব্যাবধানে কৃষি জিডিপি ৩১ ভাগ বেড়েছে।
প্রশ্ন ২ স্বাধীনতার পর হতে বাংলাদেশের জিডিপির বৃদ্ধির সাথে সাথে জিডিপিতে কৃষির অবদান বাড়েনি কেন?
আসুন ব্যাপারটি একটু খোলাসা
করি।
মোট অবদানকে আমরা ১০০ % দিয়ে
প্রকাশ করি। ধরুন, পাকিস্তান আমলে মোট জিডিপিতে কৃষির অবদান ৬৫% ভাগ ছিল। বাকি ৩৫ ভাগ
ছিল শিল্প খাত সহ অন্নান্ন খাতে। বাংলাদেশ হওয়ার পর সরকার শিল্প ও সেবা খাতের উন্নয়ন
করতে এই প্রধান দুটি খাত ও জিডিপিতে অবদান রাখে। যেহেতু এই দুটি খাতের অবদান আগে ছিল
৩৫ ভাগ, উন্নীত হওয়ার পর এই দুটি খাতের মোট অবদান ৩৫% এর উপরে উঠে গেছে। অর্থাৎ ১০০
ভাগের মধ্যে আরো কিছু পার্সেন্টেজে বেড়েছে যা কৃষির অবদান হতে কমে গেছে। এভাবে শিল্প ও সেবা খাতের ক্রমান্বয়
প্রবৃদ্ধির কারণে কৃষির অবদান ১০০ ভাগের মধ্যে ৬৫ থেকে কমতে কমতে বর্তমানে ১১ ভাগে
এসে থেকেছে। তার মানে এই নয় যে আমাদের মোট জিডিপিতে কৃষির ভূমিকা কমে গাছে। এর আগেই
আমরা জানলাম যে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের কৃষি জিডিপি ৩১ ভাগ বেড়েছে যদিও ১৯৬০ সালে
কৃষির অবদান ছিল ৬৫ ভাগ, ১৯৭০ সালে ছিল ৩৮ ভাগ এবং বর্তমানে ১১ ভাগ।
আসুন
এবার আমরা স্বাধীনতার আগে কৃষি জিডিপি ও অন্নান্ন জিডিপির % তুলনা করি:
স্বাধীনতার আগে কৃষি জিডিপি ও অন্নান্ন জিডিপির % তুলনা
প্রশ্ন 3 অন্যান্য উন্নয়নশীল মধ্যম-আয়ের দেশের কৃষি জিডিপি কেমন?
স্টাটিস্টা ডট কম এর ওয়েবসাইটতে প্রকাশিত কয়েকটি দরিদ্র আফ্রিকান দেশের ২০২৩ সালের উপাত্ত হতে দেখা যায় যে - এই দেশগুলোর মাথা পিছু বার্ষিক জিডিপি ২৪৬ - ৭০৩ ডলার মাত্র (ppt/photo) বাংলাদেশে যা ২৫২৮ ডলার। অর্থাৎ আফ্রিকান এই দেশগুলোর মাথাপিছু বার্ষিক যায় বাংলাদেশের এক দশমাংশ হতে একতৃতীয়াংশ মাত্র। বুরুন্ডির সাথে এরকম কম আয়ের দেশগুলো হলো, সিয়েরা লেওন, দক্ষিণ সুদান, মাদাগাস্কার, সুদান, সেট্রাল আফ্রিকা রিপাবলিক, মালায়ি, ইয়েমেন, নাইজার, মোজাম্মবিক, কঙ্গো ও সাদ।
Sectoral share (%) of GDP of Burundi
আমরা বুরুন্ডির ঐতিহাসিক জিডিপিটি
যদি বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখা যায় যে ২০১২ সালে বুরুন্ডির সবচাইতে বেশি জিডিপি এসেছে
সেবা খাত থেকে। আসলে পৃথিবীর সব দেশেই সেবা
খাতের জিডিপি সর্বোচ্চ। বাংলাদেশেও সেবা খাতের জিডিপির অবদান অন্য দুটি খাতের চাইতে
বেশি। মোট জিডিপির অর্ধেকের উপরে (৫১%)। বুরুন্ডিতেও এমনটি ছিল ২০১২ তে সেবা খাতে বুরুন্ডির
জিডিপির অবদান ছিল ৩৮.৮৫ শতাংশ। শিল্প খাতে ১৫.৭৫ ও কৃষি খাতে ৩৫.৫২ %। তার মানে শিল্প
খাতেরর অবদানের চাইতে দ্বিগুন জিডিপি এসেছে কৃষি খাত হতে।
২০২২ সালে বুরুন্ডির জিডিপির
খাতগুলোর পজিসন ২০১২ এর মতোই ছিল। তবে সেবা খাতের জিডিপির অবদান ২০১২ সালের চাইতে আরো বেড়ে ৪৫.৩৭ এ এসেছে, আর কৃষি
ও শিল্প দুটিই কমেছে। তার মানে তাদের শিল্প খাত বাংলাদেশের শিল্পখাতের জিডিপির মতো
না বেড়ে কৃষির সাথে কমে গিয়েছে। তাহলে কি দাঁড়ালো? মোট জিডিপি বৃদ্ধি হলেও কৃষির জিডিপি
প্রায় সব দেশেই কমে যায়।
এবারে আমরা দেখবো ধনী দেশের
কৃষি জিডিপি শিল্প ও সেবা খাতের তুলনায় কেমন বাড়ে না কমে। অর্থাৎ প্রশ্ন হলো,
প্রশ্ন ৪ বিভিন্ন উচ্চ আয়ের ধনী দেশের কৃষি জিডিপি কেমন?
জিডিপিতে কৃষির অবদান কমে যাওয়ার কারণ বিশ্লেষণ
কৃষিকে শিল্পের চাইতে লাভজনক
পেশায় পরিণত করতে পারলে মোট জিডিপিতে কৃষির অবদানই বেশি থাকতো।
বর্তমানে কৃষি জিডিপি অন্য খাত হতে কম রয়েছে। এই অবস্থাকি স্বাধীনতার আগেও ছিল
? আমরা কিছুক্ষন আগেই দেখেছি যে স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশের কৃষি জিডিপির অবদান বর্তমানকার কৃষি জিডিপির অবদান হতে পাঁচগুণেরও বেশি
ছিল।
ওই
একই প্রশ্ন আসে যে স্বাধীনতার পর হতে বাংলাদেশের
কৃষি জিডিপির অবদান না বেড়ে কেন কমেছে ?
স্বাধীনতার
পর হতে বাংলাদেশের জিডিপির বৃদ্ধির সাথে সাথে কৃষির কৃষি জিডিপির অবদান বাড়েনি কেন?
এই প্রশ্নের উত্তর আমরা এভাবে পেয়ে গেছি যে সেবা ও শিল্প খাত হতে বাংলাদেশের জিডিপি
স্বাধীনতার পর অনেক বেড়ে গেছে বলে মোট জিডিপিতে এই দুটি খাতের অবদান বেড়ে গেছে।
তবে
আগেই বলেছি, এই প্রশ্নের উত্তর আমরা পরবর্তী
আর একটি ভিডিওতে বিস্তারিতভাবে পাবো।
তবে
এখানে একটু জানিয়ে রাখি যে শিল্পখাতের উন্নতির সাথে সাথে সব দেশেরই মোট জিডিপিতে কৃষির
জিডিপির অবদান কমে আসে। কারণ মোট জিডিপিতে শিল্পের অবদান বেড়ে যায়।
আর
একটি কথাও এখানে বলে রাখি, এখনো এমন অনেক অনুন্নত দেশ রয়েছে যেখানে এখনো কৃষির জিডিপি
অন্য সেক্টর হতে বেশি। ওই সমস্ত দেশের উদাহরণ আমরা কিছুক্ষন আগে সারণি ও চিত্রের মাদ্ধমে
দেখলাম।
আর
একটি ব্যাপার বলে রাখি - সাধারণত শিল্প ক্ষেত্রে যে দেশ যত উন্নত হয়, সে দেশের মোট
জিডিপিতে কৃষির অবদান ততো কমতে থাকে।
কৃষিকে
শিল্পের চাইতে লাভজনক পেশায় পরিণত করতে পারলে মোট জিডিপিতে কৃষির অবদানই বেশি থাকতো। এই ব্যাপারগুলো আমরা পরবর্তী ভিডিওগুলোতে আলোচনা
করবো।
Source: Jastor.org: Measurement of Structural Change
in the Pakistan Economy : A Review of the National Income Estimates 1949/50 to
1963/64 on JSTOR
১৯৬১ সাল থেকেই কৃষির জিডিপি বৃদ্ধিহার মোট জিডিপি বৃদ্ধির হারের চাইতেও বেশি ছিল।
প্রশ্ন ৫ দেশের মোট জিডিপি বৃদ্ধির তুলনায় কৃষি জিডিপি বৃদ্ধির হার কেমন ছিল?
উত্তর হলো মোট জিডিপি বৃদ্ধির
তুলনায় কৃষি জিডিপি বৃদ্ধির হার অনেক বেশি ছিল। আসুন আমরা খুব সংক্ষেপে বাংলাদেশের
জিডিপির চিত্রগুলো এক পলকে একবার দেখে নেই।
নিচের গ্রাফটি হলো আমাদের মোট জিডিপির গতিপথ। আর পরের গ্রাফটিতে
আমরা এই গতিপথকে একটু বিশ্লেষণ করেছি।
এবারে আসুন এই যে মোট জিডিপি চুয়ালিশ হাজার কোটি
টাকার উপরে, এটির ভাগ বর্তমানে তিনটি খাতের
কোনটির গহ্বরে কতটুকু? নিচের গ্রাফটি দেখুন।
তাহলে এই গ্রাফ হতে আমরা দেখলাম যে - কৃষি জিডিপির
দ্রুত
বৃদ্ধি
হয় ১৯৮৫
সাল
হতে।
এবার
আসুন আমরা দেখি আমাদের
কৃষি জিডিপি
বৃদ্ধির হার মোট জিডিপি
বৃদ্ধির তুলনায় কেমন ছিল। আমরা
এই দুটি খাতের সাথে
সংশ্লিষ্ট গ্রাফ দুটিকে পাশাপাশি নিয়ে আসি।
প্রথমেই
আমরা ডান দিকের
মোট জিডিপির গ্রাফটি দেখি। দেখুন এক্স এক্সিসের সাথে
মোট জিডিপির গ্রাফের স্লোপটি অনেক কম, ধরুন
দু তিন ডিগ্রী (a)।
বিপরীত
দিকে বাম পাশের কৃষি
জিডিপির স্লোপটি দেখুন এটি মোট জিডিপির
তুলনায় অনেক বড়। কত
হতে পারে? অন্তত ত্রিশ ডিগ্রী।
এবারে
দেখুন দেশের মোট জিডিপির সর্বোচ্চ
বৃদ্ধির হার কখন থেকে
শুরু হয়? ইটা ডান
পাশের গ্রাফে। মোট জিডিপি বৃদ্ধির সর্বোচ্চ হার শুরু হয় ২০০৮ এর পর হতে।
অথচ
কৃষির সর্বোচ্চ বৃদ্ধির হার
শুরু
হয় বাম পাশের গ্রাফে ১৯৮৫ হতে। তার মানে এই দাঁড়ায় যে দেশের শিল্প ও সেবা খাতের জিডিপি খুব দ্রুত হারে বাড়তে থাকে ২০০৮
থেকে।
অর্থাৎ কৃষি
জিডিপি দ্রুত বৃদ্ধির সময়কাল ১৯৮৫ হলেও দেশের মোট জিডিপির দ্রুত বৃদ্ধির সময়কাল ২০০৮ সাল হতে।
বাংলাদেশের কৃষি উপখাতগুলোর জিডিপি বিশ্লেষণ
আমরা এবার দেখবো কৃষি জিডিপির কি কি উপখাত রয়েছে। বাংলাদেশে কৃষি খাতের পাঁচটি উপখাতগুলো হলো মাঠ ও বাগান কৃষি, প্রাণীজ কৃষি, বন কৃষি, ও মৎস কৃষি। এই ডাটাগুলোর ভিত্তি হলো ২০১৫-১৬ অর্থ বছর। ২০১৭-১৮ সালে উপখাতগুলোর যে ক্রমশ্রেণীধারা ছিল ,তা এখনো একই রকমই রয়েছে । মোট কৃষির অবদানের (১৩-১৪%) মধ্যে সবচাইতে বেশি জিডিপি অবদান ছিল ১৯১৭ ১৮ সালে ১ মাঠ কৃষির (৬.৩৯%), ২ মৎস কৃষির ২.৭৭%, ৩ পশু সম্পদ কৃষির ২.১৭%, ও ৪ বন কৃষির ১.৮১। ১৯২১-২২ সালে এই মানগুলোর সবগুলো কমে যথাক্রমে হয়েছে ১ মাঠ কৃষির (৫.46%), ২ মৎস কৃষির ২.53%, ৩ পশু সম্পদ কৃষির ১-91%, ও ৪ বন কৃষির ১-৭২%। কৃষির মোট জিডিপি ১৯১৭-১৮ এর ১৩.১৪% হতে কমে ২০২১-২২ সালে হয়েছে ১১.৬১ যা বর্তমানে ২০২৩ সালে ১১. ২২% । নিচের গ্রাফটি দেখুন। এই কমিটির কারণ হলো আগে যা বলেছি, শিল্প ও সেবা খাতের অবদান বেড়ে যাওয়া।
সবচাইতে বেশি প্রবৃদ্ধি ছিল বন উপখাতে যা ছিল ৫-০৮%
দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রবৃদ্ধির হার ছিল মৎস উপখাতের (4.4%)
পশু উপখাতের প্রবৃদ্ধি ২০১৭-১৮ হতে মোটামুটি ২০২১-২২ অর্থ বছর পর্যন্ত স্থির ছিল। (3.00%)
সবচাইতে কম প্রবৃদ্ধির হার ছিল ফসল উৎপাদন খাতের (2.65%)
প্রশ্ন ৬
কম জিডিপির কৃষির গুরুত্ব বাংলাদেশের আর্থ- সামাজিক প্রেক্ষাপটে কতটুকু?
[Food Production Index:Measures the changes in
the production of food crops that are considered edible and that contain
nutrients in a given year relative to base year.]
Relations between percapita GDP and Poverty of a country
আমরা নিচের দুটি চিত্র বিশ্লেষণ করি। প্রথমটিতে দেখা যায় যে কোনো দেশের মাথা পিছু জিডিপি,মোট জিডিপি ও কৃষি জিডিপি বাড়লে ওই দেশের দারিদ্রতায় কমে যায়। এটা আসলে একটা সাধারণ ধারণা, সবারই জানা। তবে আমাদের জানা প্রয়োজন হলো, জিডিপির কোন খাত বাড়লে দারিদ্রতা অধিক হারে বা বেশি কমানো যায়। এটা জানতে আমরা যদি পরের গ্রাফটি দেখি।
Chen and Ravallion, 2008
Poverty Profile of Bangladesh in 2022: The
headcount rate (HCR) in 2022 using the upper poverty line is 18.7%
at the national level, 20.5% in rural areas, and 14.7% in urban areas.
Relations between Agri GDP & Poverty
মাথাপিছু আয়কে যদি আমরা দুভাবে চিন্তা করি, যেমন মাথাপিছু মোট জিডিপি এবং মাথাপিছু কৃষি জিডিপি।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে মাথাপিছু মোট জিডিপি এবং মাথাপিছু কৃষি জিডিপি
এই দুটি প্যারামিটার যদি বাড়ানো যায়, তাহলে দেশের মানুষের দারিদ্রতা কমে যায়। অর্থাৎ
গ্রামীণ মানুষের উন্নতি হয়। গ্রামীণ মানুষদের প্রসঙ্গ এজন্য আনলাম- কেননা বেশির ভাগ
দরিদ্র মানুষ গ্রামেই বাস করে।
তবে Alain de Janvry এবং Elisabeth Sadoulet নামে দুইজন বিজ্ঞানীর একটি প্রবন্ধের এবস্ট্রাক্ট হতে জানা যায় -মাথাপিছু মোট জিডিপি যদি ১০% বাড়ানো যায়, তাহলে একটি দেশের দারিদ্রতার স্থিতিস্থাপকতা হয় 0.৭২%। কিন্তু কোনো দেশের মাথাপিছু কৃষি জিডিপি যদি ১০% হারে বাড়ানো যায়, তাহলে ওই দেশের দারিদ্রতার স্থিতিস্থাপকতা হয় ২.২৬%। মানে তিন গুণেরও বেশি।
বিশ্বব্যাংকের /elibrary.worldbank.org/ ওয়েবসাইটে প্রকাশিত Alain de Janvry এবং Elisabeth Sadoulet নামে
দুইজন
বিজ্ঞানীর একটি প্রবন্ধের এবস্ট্রাক্ট হতে জানা যায়, কৃষি জিডিপির বৃদ্ধি সরাসরি চল্লিশ ভাগ দরিদ্রমানুষের
দারিদ্রতা দূর করতে
ভূমিকা রাখে যা অকৃষি খাতের জিডিপির চাইতে তিনগুন বেশি ফল দিয়ে থাকে। এই তথ্যটিকে যদি আমরা
নিচের চিত্রটি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি থাহলে কেমন হয়?
প্রিয় পাঠক, তাহলে এবার নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন, বাংলাদেশের দারিদ্রতা কমানোর জন্য কৃষির জিডিপি বাড়ানো খুবই প্রয়োজন।
আর কৃষির জিডিপি বাড়াতে হলে এই খাতে আরো অধিক বিনিয়োগ করতে হবে। তার মানে আমাদের বাজেটে কৃষি খাতে আরো বেশি বরাদ্দ থাকতে হবে। মূলত একটি দেশের বাজেটের একটি প্রধান দর্শন থাকে। তা হলো এই বাজেটের প্রধান লক্ষ্য লক্ষ্য হলো কি? আমি দেশের একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে যা ভাবি, আমাদের এই দরিদ্রপীড়িত দেশের বাজেটের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত দেশের মানুষের দারিদ্রতা কমিয়ে নিয়ে আসা। আর যেহেতু বেশিরভাগ দরিদ্র মানুষই গ্রামে বাস করে এবং তাদের জীবিকার প্রধান পেশা কৃষিকাজ, সেহেতু কৃষিতে সবচাইতে বেশি বাজেট থাকা উচিত।
পরের পর্বগুলোতে আমরা আলোচনা করবো, কিভাবে বাংলাদেশের কৃষির জিডিপি বাড়ানো যাবে।
আজ তাহলে এ পর্যন্তই
ভালো থাকুন, আল্লাহ হাফিজ
No comments