রাতের বুড়িগঙ্গা: যমুনায় তাজমহলের আলোর ঝলকানি যেনো!
রাতের বুড়িগঙ্গা: যমুনায় তাজমহলের আলোর ঝলকানি যেনো!
বুড়িগঙ্গার পরিচয়
ঢাকাকে চেনেন, অথচ বুড়িগঙ্গাকে চেনেননা, এমন মানুষ মনে হয় বাংলাদেশে নেই। বুড়িগঙ্গা মানে পুরাতন গঙ্গা। বুড়ি মানে পুরাতন, আর গঙ্গা মানে বাংলাদেশ অংশের পদ্মা নদীর অংশ। কোনো এক সময়ে গঙ্গা
নদী তার পুবের একটি ধারা ধলেশ্বরী নদীর মাদ্ধমে এই বুড়িগঙ্গা
নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরে তার পানি বিসর্জন দিতো। কালের বিবর্তনে পলি পড়ার কারণে ধলেশ্বরী ও গঙ্গার মাঝে চর পড়ে গঙ্গার এই সংযোগটি বন্ধ হয়ে যায় এবং গঙ্গার সাথে বঙ্গোপসাগরে পানি নিঃসরণকারী ছোট্ট
বুড়িগঙ্গা নদীটিও গঙ্গার সাথে তার সংযোগ হারিয়ে ফেলে। তবে লোকমুখে বুড়িগঙ্গা উপাধি নিয়ে আজও সেই ছোট নদীটি টিকে আছে এবং মূল গঙ্গার সাথে তার আত্মিক সংযোগ-ইতিহাসটিকে
আজও অক্ষুন্ন রেখেছে।
হ্যাঁ ভাই, ঘটনা সত্যি, আজ হতে অনেক আগের কথা। তখন ঢাকার দক্ষিণের বাংলাদেশের অনেক এলাকারই জন্ম হয়নি। সে কালে বঙ্গোপসাগর ঢাকা হতে বেশি দূরে ছিল না। আর এই সময়টি ছিল পালা ও সেন সাম্রাজ্যের সময়ে অষ্টম
শতাব্দী হতে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে, মানে মধ্য যুগের প্রথম ভাগে। তখন বুড়িগঙ্গা একটি যৌবনবতী
নদী ছিল।
বুড়িগঙ্গা পাড়ের প্রাচীন ঢাকার কথা
আর এই যে ঢাকা শহর দেখছেন, তা কি মুঘল বা ব্রিটিশ যুগে এমনটি ছিল? না ছিল না। সেকালের ঢাকা শহর ছিল বর্তমানকার ঢাকা মহানগরীর বারো ভাগের এক ভাগ। মোঘল ও ব্রিটিশ আমলে ঢাকা শহরের আয়তন ছিল দশ থেকে পনেরো বর্গ মাইল মাত্র যা বর্তমানে ১১৮ বর্গ মাইল। বুড়িগঙ্গার উত্তর তীরের এই ছোট্ট শহরটির লোকসংখ্যা ছিল মাত্র এক থেকে দুই লক্ষ জন। মানে বর্তমানকার জনসংহার দুইশত চল্লিশ ভাগের এক ভাগ। তবে অতীতের ঢাকা ও বর্তমানকার ঢাকা বুড়িগঙ্গার উত্তর তীরেই অবস্থিত বলে এখনো সবাই প্রচার করেন।
মোঘল সম্রাট ইসলাম খান সপ্তদশ শতাব্দীতে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও
হতে ঢাকাতে বাংলার রাজধানী স্থানান্তর করেন। প্রশাসনিক সুবিধা, যোগাযোগ, প্রতিরক্ষা
ও ব্যবসা বাণিজ্যে সোনারগাঁওয়ের চাইতে ঢাকাই তার কাছে অধিক উপযুক্ত বলে মনে হয়েছিল।
বিশেষ করে বুড়িগঙ্গা নদীটির কারণে।
আর নাব্যতা, সৌন্ধর্য, প্রশস্ততা, গভীরতা, সেকালের বুড়িগঙ্গার ইত্যাদি
জৌলুশযে বর্তমানকার চাইতে অনেক বেশি ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে বুড়িগঙ্গার বর্তমানকার
একটি অবস্থার কথা আজকের ভিডিওতে আলোচনায় নাইবা আনলাম। আজকের ভিডিওতে আমরা শুধুমাত্র
বুড়িগঙ্গার সুন্দর রূপটিকেই দেখতে চাই। সুন্দর বুড়িগঙ্গা। সুন্দুরী বুড়িগঙ্গা। আজ রূপসী
বুড়িগঙ্গার রূপটিই আমরা দেখবো।
বুড়িগঙ্গা ও ঢাকা: সেকাল ও একাল
সেকালের বুড়িগঙ্গা ছিল এগারো কিলোমিটার লম্বা। বর্তমানের বুড়িগঙ্গার গতিপথ নাকি সাত কিলোমিটার। ভূমিদস্যুরা নাকি বুড়িগঙ্গার চরে বাড়িঘর করে বুড়িগঙ্গাকে দখল করেছে। সেকালে বুড়িগঙ্গার উত্তর পারে ছোট্ট শহরটিতে গুটি কয়েক এলাকাতে স্বল্প সংখ্যক লোকজন বসবাস করতো। ইতিহাস বলে, মোঘল সুবেদার ইসলাম খানের সময়ে ১৬০৮ সালে এক থেকে দুই লক্ষ লোক ঢাকা শহরে বসবাস করতো। যা ব্রিটিশ আমলে নয় লাখে এসে থামলেও বর্তমানকালে দুই মহানগরের জনসংখ্যা দুই কোটি চল্লিশ লক্ষের মতো। মোঘল আমলে এলাকাগুলো ছিল ছোট কাটারা, বড় কাটারা সহ বংশাল পর্যন্ত আরো কিছু এলাকা। তবে তা বিস্তৃত হয়ে ব্রিটিশ আমলে ধানমন্ডি হতে শাহবাগ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।
বুড়িগঙ্গার জোয়ার
বর্তমানকার বুড়িগঙ্গার সংযোগ দক্ষিণ প্রান্তের সীমানা ঢাকার দক্ষিণ পূর্বে ধলেশ্বরী নদীর সাথে, আর উত্তর সীমানা ঢাকার দক্ষিণ পশ্চিমের কামরাঙ্গীর চরের উত্তরে তুরাগ নদীর সাথে। ধলেশ্বরী বুড়িগঙ্গার চাইতে অনেক বড় নদী হলেও বুড়িগঙ্গা পানি পায় উত্তরের তুরাগ নদী হতে। ঢাকা শহরের মধ্যে হলেও বুড়িগঙ্গায় জোয়ার হয় তুরাগ হতে পানি নিয়ে। কেউ কেউ আমিন বাজার পর্যন্ত তুরাগকেও বুড়িগঙ্গা বলে বিবেচনা করে থাকেন ।
ঢাকা শহরে বুড়িগঙ্গা নদীর গুরুত্ব
ঢাকা শহরে বুড়িগঙ্গা নদীর গুরুত্ব বলে শেষ করা যাবে না। বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলের ঢাকামুখী অধিকাংশ মানুষের ঢাকা শহরের সাথে যোগাযোগ হয় এই বুড়িগঙ্গার মাদ্ধমে। বড় বড় লঞ্চ ও স্টিমার চলাচল করে এই বুড়িগঙ্গার বুক চিরে চিরে। প্রতিদিন মোট দুই শত বড় বড় লঞ্চ ও ত্রিশ হাজার ছোট ছোট নৌযানের যাতায়াত হয় এই বুড়িগঙ্গা নদীর পানিতে ভেসে ভেসে সদর ঘাটকে কেন্দ্র করে।
বাকল্যান্ড বাঁধ, বড় কাটারা, ছোট কাটারা, আহসান মঞ্জিল, লালবাগের কেল্লা সহ আরো দুটি দুর্গ হলো বুড়িগঙ্গা তীরের প্রাচীন কালের প্ৰসিদ্ধ স্থাপনা। বর্তমানে বুড়িগঙ্গার দু-তীর জুড়ে কত যে আকাশ চুম্বি স্থাপনা রয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
রাতের বুড়িগঙ্গার রাতের সৌন্ধর্য
বর্তমানকালে বুড়িগঙ্গার তলদেশ ও পানির কোনো শ্রী না থাকলেও বুড়িগঙ্গার
দুই তীরের সু-দৃশ্য পরিবেশ অবশ্যই আপনাকে মুঘ্ধ করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে দু
পারের মনোরম সৌন্ধর্য দেখতে হলে আপনাকে বেড়াতে হবে বুড়িগঙ্গার বুকের উপর দিয়ে কোনো
এক জলযান দিয়ে।
বুড়িগঙ্গার সৌন্ধর্য দিনের বেলায় এক রকম - আবার রাতের বেলায় আরেক
রকম। দিনের বেলায় বুড়িগঙ্গার দুতীরের দৃশ্য যেরকম আপনার কাছে ভালো লাগবে, রাতের বুড়িগঙ্গার
বুকের দৃশ্য আপনার মনকে যে উতলা করবে - এটা আমি একশো পার্সেন্ট নিশ্চিত। তবে বুড়িগঙ্গার
রাতের এই মনোলোভা রূপকে চোখ ও মন দিয়ে অনুভব করতে হলে আপনার দুটি প্রেমিক চোখ থাকতে
হবে।
যমুনার ওপারের লাল দুর্গ হতে রাতের বেলায় বন্দি শাজাহান যেমন করে যমুনার বুকে তাজমহলের নৃত্যরতা আলোর মুগ্ধতায় মমতাজের পরশ নিতো, তেমনি করে দুটি প্রেমিকের চোখে উপভোগ করতে থাকুন- রাতের বুড়িগঙ্গার ঝলমলে রকমারি আলোর খেলা।
শুভেচ্ছা নিরন্তর।
No comments